Mosharraf Karim - মোশাররফ করিম
তিনি বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা। তার অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা বাংলাদেশের অভিনয়জগতে এক আলাদা স্থান করে দিয়েছে।
জন্মঃ
মোশাররফ করিম ১৯৭০ সালের ২২শে আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহন করেন।
প্রাথমিক জীবনঃ
যদিও
তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহন করেন, তার বাড়ি বরিশাল-এ। ডেইলি স্টার-এ দেয়া এক
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে তার অভিনয়ে দক্ষতা জন্ম নেয় তার স্কুল
থিয়েটারে। ১৯৮৬ সালে তার অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা অন্য মাত্রা নেয় ও তিনি
নাট্যকেন্দ্র-এ যোগদান করেন। তিনি এখনও এই নাট্যদলের সদস্য।
মোশাররফ করিমের কিছু ইতিকথাঃ
(২০১৩ সালের প্রথমের দিকের একান্ত আলাপনে পাওয়া কিছু তথ্য)
আড়িয়াল
খাঁ পাড়ের পিঙ্গলাকাটী গ্রাম। এই গ্রামেরই আব্দুল করিম স্বপ্ন দেখেছিলেন।
দেশবিখ্যাত অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন। কপালের ফের, আব্দুল করিমের সেই স্বপ্ন
শেষতক সত্যি হয়নি। সে সময় যাত্রাপালার দিকে ঝোঁক ছিল আব্দুল করিমের। নিজের
এলাকায় খানিকটা নামডাকও সবে ছড়াতে শুরু করেছিল তাঁর। কিন্তু নামডাক দিয়ে তো
আর পেট ভরে না। তত দিনে সংসার বড় হতে শুরু করেছে। বৈষয়িক ভাবনাচিন্তা
অচিরেই কাবু করে ফেলল আব্দুল করিমকে। অভিনয়-অন্তপ্রাণ এই মানুষটা একদিন
সত্যি সত্যিই তাঁর প্রিয় জগৎ থেকে পুরোপুরি ইস্তফা নিয়ে নিতে বাধ্য হলেন।
মন দিলেন ব্যবসায়। বরিশালের পিঙ্গলাকাটীর আব্দুল করিমের অভিনেতা বনে যাওয়ার
স্বপ্ন এভাবেই মাঠে মারা গেল।
সংসার
ভেসে যাওয়ার ভয়ে আব্দুল করিম অভিনয় ছেড়েছিলেন। ঢাকার বাসিন্দা হয়েছিলেন।
খুব সত্যি কথা। কিন্তু ওই যে অভিনয়ের দিকে তাঁর অন্তরের টান, সেটা ফিকে
হয়নি কখনো। প্রমাণ, তাঁর অষ্টম সন্তান মোশাররফ হোসেন। একদম ছোট্টটি থেকেই
পাজির পা ঝাড়া। ভুল করেও কোনো দিন বইখাতার নাম মুখে আনে না। সাইকেলে চেপে
কোথায় কোথায় ঘুরতে চলে যায়। ডানপিটে ছেলেকে কোনোমতেই কায়দা করতে না পেরে
শেষে অন্য রাস্তা দেখলেন বাবা। উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশযাত্রার মতো ছেলেকে
ফেরত পাঠালেন বরিশালের গ্রামের বাড়িতে।
মোশারফ গ্রামে ফিরে গেলেন। গ্রামে গিয়ে
ভালো রকমের বেকায়দায় পড়ে গেল মোশাররফ। শহরের পরিচিত বন্ধুরা নেই। যখন তখন
খেলতে যাওয়া বারন। সাইকেলে চেপে ঘোরাঘুরি নেই। বিদ্যুৎ নেই। দুনিয়ার
অশান্তি। কিন্তু বাচ্চা মানুষের দুঃখ বোঝে কে? মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো
অনেকটা জোরজবরদস্তি করেই মোশাররফকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো পিঙ্গলাকাটীর
চিপারটাইপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মোশাররফ মুখ বুজে সয়ে গেল সব। কারণ
গ্রামে অভিভাবক বলতে ছিলেন তাঁর মেজো ভাই, যাকে সে যমের মতো ভয় করে।
মেজো
ভাইয়ের ভয়েই কি না কে জানে, একসময় সত্যি সত্যিই স্কুলের “গুড বয়” হয়ে উঠতে
লাগল এককালের “স্কুল পলাতক” ছেলেটা। যে অঙ্কের কথা শুনলে তাঁর ঘাম দিয়ে
জ্বর আসত সেই অঙ্কেই পেল ৯৮। তাজ্জবের ওপর তাজ্জব। যে গ্রামে এসে পেরেশানির
শেষ ছিল না সেই গ্রামই একসময় প্রিয় হয়ে উঠতে লাগল মোশাররফের কাছে।
অন্যদের অঙ্গভঙ্গি, গলার স্বর নকল করার
অভ্যাসটা তার ছিল শুরু থেকেই। বাবার প্রশিক্ষণের কল্যাণে আবৃত্তি করত
চমৎকার। হাইস্কুলে ওঠার পর এসব আপাত ছোটখাটো গুণই আলাদা করে তুলতে শুরু করল
মোশাররফকে। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই মোশাররফ আর মোশাররফ।
আবৃত্তিতে প্রথম পুরস্কার তো অভিনয়ে জোরদার হাততালি। একই সঙ্গে চলছিল
যাত্রাপালায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়।
মা
আর বড় ভাইয়েরা মোশাররফের অভিনয়প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হওয়ার চেয়ে শঙ্কিতই হয়ে
উঠছিলেন বেশি। কিন্তু মাথার ওপরে বটবৃক্ষ হয়ে ছিলেন বাবা। আব্দুল করিম আলবৎ
জানতেন, যাত্রার দিকে ঝোঁক মানেই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। নিন্দুকদের ভাষায়,
স্রেফ গোল্লায় যাওয়া। তাই সামনাসামনি ছেলেকে উৎসাহ দেওয়ার সাহস পেতেন না
খুব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মনেপ্রাণে চাইতেন, ছেলে যেন অভিনয়টা চালিয়ে যায়।
ছেলেকে উসকে দিতেই তিনি ঢাকায় এনে তাকে রীতিমতো টিকিট কেটে নিয়ে যেতেন
মঞ্চনাটক দেখাতে। অভিনয়ের জন্য ভালোবাসা না থাকলে এমন হয়?
আব্দুল করিমের এই গোপন বাসনা অপূর্ণ
থাকেনি। নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা তিনি দেখেছিলেন ছেলে
মোশাররফের মধ্যে। মোশাররফ বাবাকে বিমুখ করেননি। মোশাররফ করিম এখন আমাদের
দেশের উজ্জ্বলতম এক তরুণ অভিনয়প্রতিভার নাম।
মোশাররফ বলেন, আমার জীবনে অনেক মিরাকল আছে। মিরাকল। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ক্যারাম করাটা তাঁর একটা।
সংক্ষেপে
বৃত্তান্তটা মোটামুটি এ রকম: যে সময় ক্যারাম করার প্রস্তাব পেলেন ঠিক সে
সময়ই মোশাররফের আরেক নাটকের কাজে যাওয়ার কথা ব্যাংকক। তিনি হয়তো ব্যাংককই
যেতেন। কিন্তু তাঁকে তাজ্জব বানিয়ে ক্যারাম করার জন্যই পীড়াপীড়ি শুরু করলেন
স্ত্রী রোবেনা রেজা জুঁই। মোশাররফ স্ত্রীর কথায় রাজি হলেন। আর এই ক্যারামই
বদলে দিল মোশাররফ করিম নামের এক প্রায় চালচুলোহীন অভিনেতার জীবন।
এসএসসি পাস করে ঢাকায় এসে নাম লিখিয়েছিলেন
নাট্যকেন্দ্রে। সেখানেই পেলেন তারিক আনাম খান, ঝুনা চৌধুরী, জাহিদ হাসান
এবং তৌকির আহমেদের মতো মানুষজনের সাহচর্য। সেটাই তাঁকে গড়ে দিয়েছিল
অনেকখানি। সত্যি বটে। তাই মঞ্চই ছিল মূল ধ্যানজ্ঞান (বিচ্ছু, তুঘলক, সুখ,
হয়বদন, ক্রসিবল)। টিভি নাটকের কিছু কিছু প্রস্তাব আসত ঠিক, কিন্তু প্রায়
সময়ই ব্যাটেবলে মিলত না। ক্যারাম করতে গিয়ে বুঝলেন, টিভি নাটকেও মঞ্চের মতো
নিবেদিতপ্রাণ মানুষজন আছে। চরিত্রের মধ্যে চোখকান বুজে ডুব দেওয়ার সুযোগ
আছে। আর সেটাই আমূল পাল্টে দিল মোশাররফকে।
“স্রেফ
একটা এক ঘণ্টার নাটক কীভাবে একজন অভিনেতার জীবন পাল্টে দিতে পারে তাঁর
ভালো উদাহরণ ক্যারাম। সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম আমি।
ভেবেছিলাম এটাই শেষ বল। হয় ছক্কা নয় অক্কা। সম্ভবত আমি ছক্কা মারতে
পেরেছি।” বলছিলেন মোশাররফ করিম।
মঞ্চ নাটকে তাকে বেশ কয়েকদিন না দেখতে
পাওয়ার কারন হিসেবে তিনি জানান যে নাট্যকেন্দ্রের আগের প্রায় সব
প্রযোজনাতেই তিনি কাজ করেছেন, তবে দলের সর্বশেষ প্রযোজনা প্রজাপতি নাটকে
কাজ করতে পারেননি বলে গত দু’বছর (২০১১-২০১২) তার আর মঞ্চে উঠা হয়নি। তবে
নাট্য দলের সাথে নিয়মিতই তিনি আছেন এবং থাকবেন বলে মোশাররফ জানান।
ক্যারাম
নাটকের পর আর পেছনে ফেরার কোন সুযোগ ছিল না মোশাররফ করিমের। জড়িয়ে গেলেন
সালাউদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক ‘ভবের হাট’ নাটকের সঙ্গে। ‘পিক পকেট’, ‘লস
প্রজেক্ট’ কিংবা তৌকির আহমেদের ‘দারুচিনি দ্বীপ’ থেকে শুরু করে মোস্তফা
সরয়ার ফারুকীর ধারাবাহিক নাটক ‘৪২০’, সবখানেই সমান সাবলীল মোশাররফ করিমকে
সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছেন এ দেশের ছোটপর্দার দর্শক। ‘জয়যাত্রা’ চলচ্চিত্রের
মধ্য দিয়ে তাঁর চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। তৌকীর আহমেদের নতুন ছবি ‘রূপকথার
গল্পে’ একটি অতিথি চরিত্রে কাজ করেছেন।
নাটক লেখার কাজটা এখনো অনেক বেশি উপভোগ
করেন মোশাররফ। তার বন্ধু ইউসুফ হাসান অর্কের উৎসাহেই লিখেছেন নাটক ‘একলব্য
আখ্যান’, ‘সীতায়ন’, ‘নমরুদের শকুন’।
বাবার
কথা জিজ্ঞেস করতেই একটু বিষণ্ন হলেন মোশাররফ। তার বাবা গত হয়েছেন বছর
বিশেক হতে চলল। ছেলে কতৃক বাবার স্বপ্ন পূরণ নাট্যাংশের ছিটেফোঁটাও দেখে
যেতে পারেননি বাবা কে এম আব্দুল করিম। তবে ছেলে কিন্তু তাঁর বাবাকে
ভোলেননি। তিনি জানালেন, মোশাররফ করিম নামটা আসলে বাবার প্রতি এক সন্তানের
ভালোবাসার নিদর্শন। নিজের আসল নামের শেষের হোসেন বাদ দিয়ে বাবার করিম যোগ
করে নিয়েছেন মোশাররফ। অভিনেতা হিসেবে নিজের নামের সঙ্গে তাঁর বাবার নামটাও
মানুষ বলবে, শুধু এই তার আশা। নিজ মুখে ঠিক এইভাবেই জানালেন তিনি- “বাবা
আমাকে অভিনেতা বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা বলার সাহস পাননি কোনো দিন। আজ
সামনে পেলে বাবার পা ছুঁয়ে বলতাম, বাবা, তোমার জয় হয়েছে।” মুখোমুখি বসে
বলতে বলতে মুহূর্তের জন্য অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে চোখের পানিকে আড়াল করার
চেষ্টা করলেন মোশাররফ।
তিনি
সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে সমান পরিচিত তার অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতা, উচ্চারন
দক্ষতার জন্য। তিনি অনেক পুরষ্কার বিজেতা। তাকে প্রায়শই ধারাবাহিক ও
মেগাধারাবাহিকে অভিনয় করতে দেখা যায়। পরে তিনি বাংলা সিনেমায়ও অভিনয়
করেন। তিনি বিখ্যাত ছবি ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’-এ অভিনয় করেন।
বর্তমানে তিনি বিখ্যাত পরিচালক মাসুদ সেজানের ‘লং মার্চ’ ও ‘রেড সিগনাল’-এ
অভিনয় করছেন। এছাড়াও তিনি জিম্মি, দুই রুস্তম, অন্তনগর, ফ্লেক্সিলোড,
কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আউট অফ নেটওয়ার্ক, সাদা গোলাপ, ৪২০, জুয়া, সুখের অসুখ,
সিরিয়াস কথার পরের কথা, সন্ধান চাই, ঠুয়া, লস, সিটি লাইফ, বিহাইন্ড দ্যা
সিন তাই কিছু বিখ্যাত নাটক।
তিনি
১৯৯৯ সালে এক পর্বের নাটক ‘অতিথি’-এ অভিনয় করেন। এই নাটকটি চ্যানেল আই-এ
সম্প্রচারিত হয়। যদিও প্রথম জীবন তার জন্য কষ্টের ছিল, তার সত্যিকার পথচলা
শুরু হয় ২০০৪ সাল হতে। ২০০৪ সালে তিনি দুটি নাটকে অভিনয় করেন, যা
অভিনয়জগতে তাকে এক অধ্যাবসায়ী চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি
বিখ্যাত টেলিফিল্ম ‘ক্যারাম’-এ তিশার বিপরীতে অভিনয় করেন। এরপর থেকেই তিনি
বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করা শুরু করেন। ২০০৯ সালে তিনি বিখ্যাত পরিচালক
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার’ নাম্বার ছবিতে
তিশার বিপরীতে অভিনয় করেন। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন মেগা-ধারাবাহিকে অভিনয়
শুরু করেন। তিনি তার প্রথম মেগা-ধারাবাহিক ‘৪২০’-এ অভিনয় করেন। এ
ধারাবাহিক থেকেই তিনি সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে বিখ্যাত হন। এই নাটকটি চ্যানেল
আই-এ প্রচারিত হয়। এরপর তিনি জনপ্রিয় ধারাবাহিক ভবের হাট, ঘর-কুটুম, এইম
ইন লাইফ, হার কিপ্টে, এফ এন এফ -এ অভিনয় করেন। তিনি কমেডি চরিত্রে অভিনয়
করেন। এরপর তিনি দারুচিনি দ্বীপ ছবিতে অভিনয় করেন। এই ছবি হুমায়ুন
আহমেদ-এর কাহিনীর ভিত্তি করে ও তৌকির আহমেদ-কতৃক পরিচালিত হয়। তিনি
কিছুদিন আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রজাপতি’ ছবিতে অভিনয় করে। ২০১৩ সালে তিনি
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘টেলিভিশন’ ছবিতে অভিনয় করেন। বক্স অফিসে
ঝড় তুলে দেয় এই ‘টেলিভিশন’। মুক্তির প্রথমদিনেই অবিশ্বাস্য সাফল্য দেখা
গেছে মোশাররফ করিম অভিনীত ‘টেলিভিশন’ এ। মুক্তির প্রথম দিনেই দেশের সিনেমা
হলগুলোতে দেখা গেছে তরুণ দর্শকদের প্রচন্ড ভীড়।